দৌড়…।
–রুদ্রপ্রসাদ
(১)
“এ ইউ…, স্ট্যাণ্ড আপ। বসে বসে হাত দোলাচ্ছিস কেন? এটা কি মিউজিকের ক্লাশ হচ্ছে? নাকি তুই কোনো কনসার্ট শুনছিস?” অরূপ স্যারের বিরক্তমাখা গলা শুনে একটু চমকে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝল কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। ইতস্ততঃ করে উঠে দাঁড়াতেই স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে, ডানহাতে কি করছিলি?”
“না মানে… কিছু না, স্যরি স্যার।”
“স্যরি তো বুঝলাম, কিন্তু ওটা কি করছিলি, সেটা বোঝা।” স্যারের গলায় ঈষৎ কৌতুকের আভাস দেখে একটু ভরসা পেল সায়ন্তন।
“না… মানে… রিলিজের ফলো-থ্রুটা ঠিক করছিলাম, মানে… শ্যাডো প্র্যাকটিস।” আমতা আমতা করে জবাব দিল।
“ও তো বিরাট কোহলি হবে স্যার।”
ক্লাশের ফার্স্টবয় অর্ঘ্য ফুট কাটল দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল সায়ন্তনের। তেরিয়া হয়ে বলল, “জীবনে কখনো মাঠে নেমেছিস? চশমা এঁটে সারাদিন তো বইতে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিলি, ব্যাটা গুবরে পোকা কোথাকার। একবার মাঠে এসে দেখিস, হাঁটুতে চিন-মিউজিক শুনতে পাবি।” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঘন্টার শব্দে থেমে গেল।
“এনাফ ইজ এনাফ। খেলার কথা খেলার মাঠেই রেখে আসবি। ফের যদি কখনো আমার ক্লাশে এরকম দেখি, ঘাড় ধরে বের করে দেব। আর তুই, কে বড়ো হয়ে কি হবে, সেটা কি তোর পারমিশন নিয়ে হবে! নিজের চরকায় তেল দে। আমার ক্লাশে কোনোরকম বাঁদরামি আমি সহ্য করব না। আণ্ডারস্ট্যাণ্ড? নেক্সট ক্লাশে সবার হোমওয়ার্কের খাতা যেন আমি টেবিলে দেখতে পাই।” স্যার ধমক দিয়ে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ছুটির পর মাঠ থেকে ফেরার সময় দেখল ক্লাশেরই কতগুলো ছেলের সাথে অর্ঘ্য বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। ‘এদের সাথে অর্ঘ্যের কি করে বন্ধুত্ব হয়েছে কে জানে! পড়াশোনা বা রুচি, কোথাও তো মেলে না’, অবাক হয়ে ভাবে সায়ন্তন। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলের দল পরীক্ষার হলে অর্ঘ্যের সৌজন্যে উতরে যায়। যদিও অর্ঘ্যও বিশাল পয়সাওলা ঘরের ছেলে, তবুও কোথাও বেমানান লাগে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কানে আসে, “আরে… বি-র-র-রা-ট বড়ো প্লেয়ার যাচ্ছে রে…। আবে… গুরুর পা ধুয়ে জল খা যদি পাশ করতে পারিস।” শেষের কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। তবুও উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সরে এলো।
(২)
খেলার মাঠ থেকে ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে বসেছিল সায়ন্তন। ক্লাশের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। পড়াশোনায় কোনোকালেই খারাপ ছিল না। মাধ্যমিকে বিশাল কিছু ভালো রেজাল্ট না করলেও নেহাৎ খারাপ করেনি। সেজন্য সায়েন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ পেতেও অসুবিধা হয়নি। এমনিতে কারোর সাতে-পাঁচে থাকে না, কিন্তু কিছু নম্বর বেশি পেয়ে সবসময় অর্ঘ্যের সব ব্যাপারেই হামবড়ামি একদম সহ্য করতে পারে না সে। মনে মনে ভাবে, ‘মুখে বলে নয়, একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েই সবার জবাব দিতে হবে।’
“কি রে! ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন! শরীর ঠিক আছে?” বলতে বলতে ঘরে এসে আলো জ্বেলে দিলেন সত্যব্রতবাবু। তার ফ্রেণ্ড-ফিলোজোফার-কাম-গাইড, যিনি তাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, তার সবচেয়ে বড়ো সমালোচক ও বন্ধুকে কাছে পেয়ে স্কুলের সমস্ত ঘটনা বলে একটু হালকা হ’ল সায়ন্তন। সত্যবাবু তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছিস, তার পেছনে ছোটার চেষ্টাও যখন শুরু করেছিস, তখন এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। বি ব্রেভ, হোল্ড ইওর নার্ভ এ্যাণ্ড গো অ্যাহেড। লক্ষ্য যত উঁচুতে রাখবি, পৌঁছতে ততই বাধা-বিপত্তি আসবে। ভয় পেয়ে থেমে গেলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে। নে, এবার ওঠ।”
“কিন্তু বাবা…;”
“কোনো ‘কিন্তু’ নয়। গীতায় কি বলেছে জানিস? বলেছে ‘কর্মণ্য বাধিকারাস্তে মা ফলেষু কদাচনঃ’, মানে ফলের চিন্তা না করে এক মনে কাজ করে যাও। ইংরেজিতে বলে ফলো দ্য ‘ডি’। ড্রীম, ডিজায়ার, ডিসিপ্লিন, ডেডিকেশন এ্যাণ্ড ডিটারমিনেশন, এই পাঁচটা ‘ডি’ যদি ঠিক রাখতে পারিস, তাহলেই পৌঁছে যাবি আল্টিমেট ‘ডি’ – ডেস্টিনিতে। আর যদি পাঁচটার কোনো একটাও এদিক-ওদিক হয় তাহলে হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হবে আর একটা ‘ডি’ নিয়ে – ডিসকোয়ালিফায়েড। কাজেই ফলের আশা ছেড়ে লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে মনোযোগসহকারে শ্রম করে যাও, একদিন লক্ষ্যভেদ নিশ্চিত হবে।”
মন খারাপের ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যায় সায়ন্তনের। এই জন্যই বাবাকে এতো ভালোবাসে, মনে মনে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।’
(৩)
ত্রিকোণমিতির অঙ্কগুলো করতে করতে কখন দশটা বেজে গেছে খেয়াল করেনি। মায়ের ডাকে বইপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ে। ছোটো বোনের সাথে খুনসুটি করতে করতে খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়ে সায়ন্তন। বাবার বলা কথাগুলো ভাবতে তার মনে হয়, মৃদুভাষী অনিন্দিতা দেবীর সাহচর্য্য ছাড়া বাবাও হয়তো তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাতে পারতেন না। ছোটোবেলা থেকেই মায়ের কড়া শাসন ছিল বলেই হয়তো আজ সে কিছুটা হ’লেও ডিসিপ্লিনড হতে পেরেছে। বাবাও একসময় খেলাধূলা করতেন, পরে সাংসারিক চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই পোস্ট অফিসের সাধারণ চাকরি নিতে হয়েছিল খেলাধূলা করে স্বপ্ন পূরণের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে। তাদের পড়াশোনার জন্যই সব কষ্ট সহ্য করে এই ছোট্ট দু’কামরার ভাড়া ঘরে থাকতে হচ্ছে। মনে মনে বলে, ‘তোমাদের সবার সব স্বপ্ন আমি পূরণ করব।’ ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন স্কুলে গিয়ে টিফিনের সময় পেছন থেকে টিটকারি শুনে আর স্থির থাকতে পারল না, সোজা গিয়ে অর্ঘ্যর কলার চেপে ধরল। “স্কুলে পড়াশোনা করতে এসেছিস, ওটাই কর। আমার কথা ভাবতে তোকে কেউ বেতন দিয়ে রাখেনি। পরেরবার যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলেছিস তো নিউটনের থার্ড ল আর অ্যানাটমির পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে এমন বুঝিয়ে দেব যে আর কিছু বোঝার মতো অবস্থায় থাকবি না।” দাঁত চেপে কথাগুলো ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল সায়ন্তন।
তারপর দিন তিনেক কেটে গেছে। স্কুলে প্রার্থনার সময় হেডস্যার বললেন, “আজ আমাদের একটা খুব আনন্দের দিন। আমাদের স্কুলের সায়ন্তন বেঙ্গল আণ্ডার নাইন্টিন টীমের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছে। অল দ্য বেস্ট সায়ন্তন এ্যাণ্ড মেনি মেনি কনগ্র্যাচুলেশনস্।”
খবরটা পাওয়ার পর থেকেই অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না। কোনোরকমে ছুটির ঘন্টা পড়তেই সোজা হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। বড়ো রাস্তা থেকে একটা নির্জন গলি দিয়ে শর্টকাট করে সায়ন্তন। গলিটাতে ঢোকার মুখে পেছন থেকে আসা একটা বাইকের ধাক্কায় রাস্তার একপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আচমকা পড়ে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেও বুঝতে পারল বাইক একটা নয়, অন্তত দু’তিনটে, আর বাইকগুলো থেকে কয়েকজন নেমে এসেছে। কিছু বোঝার আগেই বাঁ হাঁটুর নিচে এক প্রচণ্ড আঘাতে গলা চিরে গোঙানি বেরিয়ে এলো তার। ধূলা আর রক্তে মাখামাখি সায়ন্তন ঘাড় ঘুরিয়ে আক্রমণকারীদের মুখ দেখার চেষ্টা করতে যেতেই মাথা লক্ষ্য করে সপাটে নেমে এলো একটা হকিস্টিক। জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেল, “খুব উড়ছিলি না? নে, ডানা ছেঁটে দিলাম। একে বলে হাঁটুতে চিন মিউজিক…।” অর্ঘ্যর গলা!
(৪)
যখন চোখ খুলল, তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। ধাতস্থ হতে সময় লাগলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা। কিছু বলার চেষ্টা করেও পারল না। তবুও ঠোঁট নড়ছে ডাক্তারের পাশে দাঁড়ানো বাবা বললেন, “রিল্যাক্স। বিশেষ কিছু হয়নি। ঘাবড়ে যাওয়ার দরকার নেই।” কিন্তু পায়ের কাছে দাঁড়ানো মায়ের চোখ-মুখ দেখে বুঝেই গেল চোট রীতিমতো গুরুতর। তার যে ট্রায়ালে যাওয়া হচ্ছে না, স্বপ্নের পেছন দৌড়ানো যে সাময়িকভাবে বন্ধ হ’ল, এসব ভেবেই শারীরিক যন্ত্রণা ছাপিয়ে মনের দুঃখেই দু’চোখ জলে ভরে এলো।
ডাক্তারবাবু বেশ মজার মানুষ, পাশের টুলে বসে বললেন, “ডোন্ট ওয়্যারি, রিবসে দুটো হেয়ারলাইন ক্র্যাক হয়েছে, ও কিছু না। বাম পায়ের শিনবোনে কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার আছে, প্লাস্টার করে দিয়েছি, ছ’সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে। আর মাথায় জাস্ট খান পাঁচেক স্টিচ পড়েছে, ভেতরের ঘিলু-টিলু সব ঠিকঠাক জায়গাতেই আছে। অতএব ভয়ের কিছু নেই।” তাঁর বলার ভঙ্গিতেই এতো যন্ত্রণার মধ্যেও হেসে ফেলল সায়ন্তন। দেখে ডাক্তারবাবু আবার বললেন, “দ্যাটস্ লাইক আ গুড বয়। জীবনের ওঠাপড়ার সাথে চোট-আঘাত তো থাকবেই, তার জন্য এতো মুষড়ে পড়লে চলবে না। অলওয়েজ কীপ স্মাইলিং। তাছাড়া চোট-আঘাত না থাকলে আমাদের যে ভিক্ষা করতে হবে বাবা।”
বাকিরা সবাই চলে যাওয়ার পর বাবাকে সব কথা বলল সায়ন্তন। সত্যবাবু সজল চোখে কিছু না বলে ছেলের পায়ের প্লাস্টারের ওপর লাল মার্কার দিয়ে ‘গেট ওয়েল সুন’ লিখে একটা স্মাইলি এঁকে দিলেন।
দু’দিন পর স্কুলের হেডস্যার এলেন। সাথে পুলিশ! এসে আগে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বললেন। তারপর সায়ন্তনকে বললেন, “চিন্তা করিস না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। তোর জন্য যাতে একটা স্পেশাল ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা যায়, তার জন্য আমি স্কুলের তরফে আবেদন করব।” একটু থেমে পুলিশ অফিসারকে দেখিয়ে বললেন, “এঁর কিছু জানার আছে, সব খুলে বল। অপরাধী যেন কোনোভাবেই ছাড়া না পায়।”
পুলিশ অফিসার অমায়িকভাবেই বললেন, “তোমার বাবার কাছে মোটামুটি শুনেছি। তোমার মুখ থেকে পুরোটা শুনব। কোথাও কিছু বাদ দেবে না। তবে তোমার কিছু মনে হচ্ছে বা হয়েছে, এমন কিছু বলবে না। শুধু যা ঘটেছে, সেটাই বলো।” মোটামুটি যতটুকু মনে করতে পেরেছে, সেটাই বলল সায়ন্তন। তার বয়ান আর একজন পুলিশ লিখে নিল। তারপর আবার আসবেন বলে তাঁরা বিদায় নিলেন।
(৫)
পরের দিন দুপুরে আবার সকলে এলেন, সাথে অর্ঘ্য ও তার বাবা হৃষিকেশবাবু। হৃষিকেশবাবুই প্রথমে সায়ন্তনকে বললেন, “বাবা তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু যা ঘটে গেছে, তা তো পাল্টানো সম্ভব নয়।… তোমার কমপ্লেনে ওর জেল হতে পারে। ওর পুরো কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। তোমাকে অনুরোধ করছি, ওর এতোবড়ো ক্ষতিটা তুমি হ’তে দিও না। তোমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি দেব। চাও তো আলাদা করে ক্ষতিপূরণও দেব।”
“আপনি শুধু আপনার দিকটাই দেখছেন। ওর কত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন? সুযোগ সবাই পায় না। আজ আপনার ছেলের জন্য ওর এতো বড়ো সুযোগটা হাতছাড়া হ’ল।” বিরক্তভাবে বললেন হেডস্যার। পেছনে তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য।
সত্যব্রতবাবু উভয়ের বাদানুবাদের মাঝে চুপচাপ ছেলেকে লক্ষ্য করছিলেন। কথাবার্তা শুনতে শুনতেই মনস্থির করে ফেলেছিল সায়ন্তন। তারপর একসময় হৃষিকেশবাবুর “বাবা তুমিই বলো, এখন সবটাই তোমার হাতে।” শুনে বলল, “আমার যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। তবে আমার ক্ষতি করেছে বলে আমি কারোর ক্ষতি করতে পারব না। আমি কোনো কমপ্লেন করিনি। আপনারা যখন জানতে চেয়েছেন, তখন যা সত্যি, তাই বলেছি। আমি কোনো কমপ্লেন কোথাও করছি না। আর হ্যাঁ, যে যন্ত্রণা আমি পেয়েছি এবং পাচ্ছি, তা টাকা দিয়ে মেটানো যায় না। সবকিছুর মূল্যায়ন টাকায় হয় না।” একটানা বলে যখন থামল, ঘরে তখন অখণ্ড নীরবতা।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। একসময় হেডস্যার বললেন, “সায়ন্তন ক্ষমা করে দিয়েছে, এটা ওর মহানুভবতা। তবে সবকিছু জেনেও যদি আমি অর্ঘ্যকে ক্ষমা করে দিই, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সায়ন্তন বলল, “স্যার, আমি কিন্তু ওকে ক্ষমা করিনি। ওর কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেটাই চেষ্টা করছি। ও আমার ক্ষতি করেছে বলেই যদি আমিও ওর ক্ষতি করি, তাহলে ওর সাথে আমার পার্থক্য কোথায়?”
“তুই ঠিক বলেছিস”, বলে হেডস্যার হৃষিকেশবাবুকে বললেন, “আমি আপনার ছেলেকে রাস্টিকেট করছি না। তবে আগামীকাল এসে ওর টিসিটা নিয়ে যাবেন। আই অ্যাম সিওর, আপনি আপনার পাওয়ার আর পজিশন দিয়ে অন্য কোথাও সুযোগ পেয়ে যাবেন। তবে আমি থাকতে, আমার স্কুলে ওর জায়গা হবে না।” মাথা নিচু করে বিদায় নিলেন হৃষিকেশবাবু।
(৬)
সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছিল সায়ন্তন। বাড়ি ফিরে মায়ের সামনেই বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “অর্ঘ্যর ব্যাপারে আমার ডিসিশন কি ভুল ছিল?”
সরাসরি উত্তর না দিয়ে সত্যবাবু বলেছিলেন, “স্পোর্টসম্যান স্পিরিট্ এমন এক বিশেষত্ব যা খেলোয়াড়কে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে। তুই খেলোয়াড় হিসেবে কতটা বড়ো হতে পারবি বা জীবনে কত সাফল্য পাবি তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যখন তুই তোর মতামত জানালি, অ্যাট দ্যাট ভেরি মোমেন্ট আই ফীল প্রাউড টু বি ইওর ফাদার। রিয়েলি, আই মীন ইট।” শুনে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল সায়ন্তনের। মায়ের চোখেও তখন দেখেছিল পরিতৃপ্তি, অনিন্দিতা দেবী শুধু বলেছিলেন, “তুই উঠবি, আবার খেলবি, তবে এখন থেকে পড়াশোনায়ও মনোযোগ দিবি। সবাইকে দেখিয়ে দিবি, শুধু খেলাধূলায় নয়, পাশাপাশি পড়াশোনাতেও তুই কারোর চেয়ে কম নয়। শুধু মনে রাখিস মানুষ হ’তে হবে, সত্যিকারের মানুষ।” শুধু ছোটো বোন কিছু না বুঝতে পেরে চুপ করে দাদার দিকে তাকিয়ে ছিল।
নির্ধারিত সময়ে প্লাস্টার কাটার পর যখন বাম পায়ে জোর পাচ্ছিল না, তখন হতাশায় কেঁদে ফেলেছিল। ডাক্তারবাবু, বাবা-মা, সবাই আশ্বস্ত করলেও সংশয় কাটছিল না কোনোমতে। যখন খুব হতাশ লাগত, তখনই বোনকে নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে হাজির হ’ত, আর বাবার কাছে কথামৃত, ফোক ইত্যাদির গল্প শুনে মনের জোর খুঁজে পেত।
সময়ের সাথে সাথে দৌড়ানো শুরু করলেও বল করার সময় সমস্যা হচ্ছিল, ডেলিভারী দেওয়ার আগে স্টেপিংয়ে গোলমাল হচ্ছিল, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছে। বায়োলজি প্রাকটিক্যাল ক্লাশে গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে আসত স্কেলিটন আর হিউম্যান মাসল্ স্ট্রাকচারের ডায়াগ্রাম আর বাড়ি ফিরে সযত্নে নিজেই মালিশ করত বাম পা।
ম্যাচ ফিট না থাকার জন্য মাঠে সময় অনেক কম কাটাত। সেই বাড়তি সময়টা ব্যয় করত পড়াশোনার পেছনে। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়। যে বায়োলজিকে ফোর্থ সাবজেক্ট বলে একটু কম পড়ত, নিজের চেষ্টায় সেই বায়োলজিতেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে টুয়েলভে উঠল আশাতীত ভালো রেজাল্ট করে।
(৭)
আস্তে আস্তে সায়ন্তন ফিরে পেতে থাকে তার চেনা ছন্দ। পুরো অফ সীজনটা পরিশ্রম করার ফল পায় মরশুমের শুরুতেই। দীপাবলীর ছুটির পর স্কুল খুলতেই তার ডাক পড়ে হেডস্যারের ঘরে। যেতে হেডস্যার বলেন, “একটা ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব ট্রায়ালে তোকে দেখতে চেয়েছে, পারবি তো?” মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ফিরে আসে। তারপর থেকে প্র্যাকটিসে ডুবিয়ে দেয় নিজেকে।
মাঝে একদিন রাস্তায় তার মুখোমুখি হঠাৎই এসে পড়েছিল অর্ঘ্য, কিন্তু কিছু না বলে নেহাতই না চেনার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছিল। যদিও অর্ঘ্যর হাবভাবে তাকে কোনোভাবেই অনুতপ্ত বলে মনে হয়নি সায়ন্তনের।
খেলার মাঠে সময় বেশি দিতে হচ্ছে বলে কিন্তু পড়াশোনাকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং স্যারেদের সহযোগিতায় সামনের পরীক্ষার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করেছে নিজেকে। আর তার প্রমাণ সে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টেও পেয়েছে।
নভেম্বরের শেষের দিকে বাবার সাথে গিয়ে ট্রায়াল দিয়েও এসেছে। ফেরার পথে বাবা বলেছিলেন, “ট্রায়ালে ভালোই করলি, কিন্তু এতোবড়ো ক্লাবে একবারেই সিলেক্ট হবি – এমনটা আশা করিস না। যদি না হ’তে পারিস, তখন খারাপ লাগবে। একটা কথা মাথায় রাখিস, ‘কম্পিট উইথ ইওরসেল্ফ।’ প্রত্যেকবার চেষ্টা করবি নিজেকে উজাড় করে নিজের সেরাটাকে ছাপিয়ে যেতে।” ট্রায়ালের দিন তিনেক পরই ক্লাবের তরফে ডাক এসেছিল কন্ট্র্যাক্ট সাইন করার জন্য।
পরীক্ষার কথা মাথায় রেখেই তাকে খেলানো হবে বলে ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মনে মনে হিসেব করে, ‘বড়োজোর দশ-বারোটা ম্যাচ পাবে। তবুও পরে যাতে সুযোগ পেতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য ভালো পারফর্ম করতে হবে।’
সব সংশয়কে পেছনে ফেলে এসে পৌঁছেছে মাঠে, আজ তার প্রথম ম্যাচ। বাবার সাথে মা, বোনের সাথে হেডস্যার আর অরূপ স্যারও এসেছেন। টীম ক্যাপ্টেন তাকে বল করতে ডাকতেই আম্পায়ারকে টুপিটা দিয়ে নিরুত্তাপভাবে বলল, “রাইট আর্ম, ওভার দ্য উইকেট।” তারপর পা মেপে এগিয়ে চলল বোলিং মার্কের দিকে। উত্তেজনায় নিজের হৃদস্পন্দনকেই প্যারেডের ড্রামরোলের মতো মনে হচ্ছিল সায়ন্তনের। সামনে দেখল এখনকার বাংলা সিনিয়র দলের এক সমীহ-জাগানো ব্যাটসম্যান। হাতের বলটা ট্রাউজারে পালিশ করে প্রস্তুত হ’ল সে। একটা আসন্ন যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত ভেতরের ‘আমি’টা যেন তাকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য গর্জে উঠল, ‘দ্য গেম ইজ অন, লেটস্ রান। দ্য চেস অফ ইওর ড্রীম বিগিনস নাউ…’।।
।। সমাপ্ত ।।